রাতারাতি রাজনৈতিক পরিচয় পালাবদল হয়েছে বালু সিন্ডিকেট চক্রের। আগে আওয়ামী লীগের নাম ব্যবহার করে, এখন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি নাম ভাঙিয়ে বালু সিন্ডিকেট চক্র তাদের বালু ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। মূলত প্রশাসনের কতিপয় কর্মকর্তা কর্মচারীর ছত্রছায়ায় দেশজুড়ে নদ-নদীতে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের মহোৎসব চলছে। এতে নদীর তীর ভেঙে ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে বহু পরিবার। অভিযোগ জানিয়েও মিলছে না প্রতিকার। তবে প্রশাসন বলছে, অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধে অভিযান চলছে। শুধু তাই নয়, অবৈধ বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার হওয়ায় জেল-জরিমানাও বাড়ছে। সাম্প্রতিক সময়ে কুলাউড়া, কিশোরগঞ্জ, রাজবাড়ীও কুষ্টিয়াসহ বিভিন্ন জেলায় ভ্রাম্যমাণ আদালত অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের জেল ও জরিমানা করেছে। অনেক ক্ষেত্রে ১ থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা এবং এক মাসের কারাদণ্ডও হচ্ছে। প্রশাসন এই অভিযান অব্যাহত রাখবে এবং ভবিষ্যতে এই অপরাধে জড়ালে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, অবৈধ বালু উত্তোলন পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর, যার ফলে নদী তীরবর্তী এলাকা ধসে পড়া, কৃষিজমি ভেঙে যাওয়া এবং রাস্তা নষ্ট হওয়ার মতো ঘটনা ঘটে। তারা উল্লেখ করেন যে, এই অবৈধ কার্যক্রম বন্ধে প্রশাসনকে মূল হোতাদের চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে এবং ইজারাবহির্ভূত এলাকা থেকে বালু উত্তোলন বন্ধ করতে হবে। তবে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) সিনিয়র গবেষণা কর্মকর্তা সোমনাথ লাহিড়ী বলেন, বর্তমানে বিধিবহির্ভূত বালু ও পাথর উত্তোলন ব্যাপকভাবে শুরু হওয়ায় উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অমান্য করা হচ্ছে। অনতিবিলম্বে বিধিসম্মত উপায়ে ঘোষিত বালুমহাল থেকে বালু উত্তোলনের লক্ষ্যে প্রচলিত আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
সরেজমিনে দেশের বেশ কিছু জেলায় দেখা যায়, বালু উত্তোলনের বিশাল কর্মযজ্ঞ। একের পর এক অবৈধ ড্রেজার বসিয়ে উত্তোলন করা হচ্ছে বালু, যা পরিবহনে ব্যবহৃত হচ্ছে কয়েকশো ট্রাক। ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র নদে দিনের বেলায় প্রকাশ্যে এই কার্যক্রম চলছে। নগরীর পুলিশ লাইন থেকে সদরের ঘুন্টি, কিসমত হয়ে বেগুনবাড়ি ঘাট পর্যন্ত অর্ধশতাধিক ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এসব বালু সড়কের পাশে রেখে বেচাকেনাও চলছে। এতে জেলার ১৩টি উপজেলায় কয়েকশ ড্রেজার দিয়ে বালু তোলার কারণে তীর ভাঙছে এবং বসতভিটা ও ফসলি জমি হারাচ্ছেন মানুষ। নুরজাহান আক্তার নামে কিসমত এলাকার এক নারী বলেন, বালু তোলার কারণে প্রতিনিয়ত তীর ভাঙছে। বাড়ির অনেক অংশ নদীতে চলে গেছে। বাধা দিলে তারা মারধর করতে আসে। পাইপলাইন বাড়িঘরের ভেতর দিয়েই নিয়েছে। একই অভিযোগ কল্যাণপুর এলাকার বাসিন্দা হাবিবুর রহমানের। তিনি বলেন, সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও দিনরাত বালু উত্তোলন চলছে। মাঝে মাঝে প্রশাসন অভিযান চালালেও পরে আগের মতোই সব চলতে থাকে। ধুলাবালু বাতাসে উড়ে ঘরবাড়ি নষ্ট হচ্ছে। অনেকে শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। ময়মনসিংহ বিভাগের শেরপুরের সব নদীতে ড্রেজার মেশিন দিয়ে রাতের আঁধারে বালু তোলা হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালতের নজর এড়াতে রাতভর বালু পরিবহন করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জামালপুরের যমুনা, ব্রহ্মপুত্র ও ঝিনাইসহ ছোট-বড় নদীগুলোতেও একই চিত্র। নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে ঘরবাড়ি, বাজার, সেতু ও মহাসড়ক ঝুঁকিতে পড়েছে। নদী ভরাট হয়ে খালে পরিণত হওয়ার পাশাপাশি পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। তবে ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক বলছেন, আমরা নিয়মিত অভিযান চালিয়ে ড্রেজার জব্দসহ জরিমানা করছি। গত ২ সেপ্টেম্বর দুপুরে উপজেলার টিলাগাঁও ইউনিয়নের সালন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এ জরিমানা করেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আনিসুল ইসলাম। অভিযানে কুলাউড়া থানা পুলিশের একটি দল সহায়তা করেন। তবে এ বিষয়ে সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আনিছুল ইসলাম বলেন, নিয়ম না মেনে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করায় বালুমহালের ইজারাদারকে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। একইদিন গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার ডুমুরিয়া ইউনিয়নের কড়ফা বিল এলাকায় অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের দায়ে এক ড্রেজার মালিক ও জমির মালিককে ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড প্রদান করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এদিন দুপুরে এ অভিযান পরিচালনা করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফারজানা আক্তার। অভিযানকালে কড়ফা বিলে বালু উত্তোলনের সময় জমির মালিক রফিকুল ইসলাম (রফিক) ও ড্রেজার মালিক সিরাজুল ইসলাম সিরাজকে হাতেনাতে আটক করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) অনুযায়ী ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড প্রদান করা হয়। এ সময় ভ্রাম্যমাণ আদালত শেষে ইউএনও ফারজানা আক্তার বলেন, বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন ২০১০ অনুযায়ী অনুমোদন ব্যতীত যেকোনো ধরনের বালু উত্তোলন দণ্ডনীয় অপরাধ। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এই অভিযান চলমান থাকবে। তিনি জানান, কড়ফা বিল এলাকার পরিবেশ ও কৃষিজমি ধ্বংস করে চলা এ ধরনের অবৈধ কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই বরদাস্ত করা হবে না। ৩১ আগস্ট কিশোরগঞ্জে উপজেলার বাহাগিলি ইউনিয়নের চারালকাটা নদী থেকে অবৈধ ভাবে বালু উত্তোলন করায় এক বালু ব্যবসায়ীর কাছ থেকে দুই লাখ টাকা জরিমানা আদায় করেছে ভ্রাম্যমান আদালত। এদিন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রীতম সাহা। কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার মসূয়া ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি জহিরুল ইসলাম (জহির মেম্বার) দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে সরকারি বালুর ডাইক থেকে বালু বিক্রয় করে আসছেন। এমন অভিযোগের ভিত্তিতে গত ২৭ আগস্ট বিকেলে বৈরাগীরচর গ্রামে ব্রহ্মপুত্র নদীর পাড়ে বালুর ডাইক থেকে অবৈধভাবে বালু বিক্রয় করার সময় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ১ লাখ টাকা জরিমানা করেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) লাবনী আক্তার তারানা। স্থানীয়দের অভিযোগ, ব্রহ্মপুত্র নদ রক্ষায় সরকারের চলমান খনন প্রকল্প থেকে তুলা মাটি ও বালুর বিশাল ডাইক নির্মাণ করে রাখা হয়েছিল। পরবর্তীতে সরকারি নিলামের মাধ্যমে বালু বিক্রির সিদ্ধান্ত হলেও স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় জহির মেম্বার সেখানে অবৈধভাবে বালু ব্যবসার রাজ্য গড়ে তুলেন। প্রায় ১০ কোটি টাকার বালুর মধ্যে ইতিমধ্যে প্রায় ছয় কোটি টাকার বালু বিক্রি হয়ে গেছে এখনো প্রায় ৪ কোটি টাকার বালু মজুদ রয়েছে বলে এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়। ২৬ আগস্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগরে মেঘনা নদীতে অবৈধ বালু উত্তোলন অভিযোগে ভ্রাম্যমাণ আদালত ইজারাদার শাহাওয়াত হোসেনের প্রতিষ্ঠান মেসার্স সামিউল ট্রেডার্সকে দুই লাখ টাকা জরিমানা করেছে। অভিযান পরিচালনা করেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট খালিদ বিন মনসুর। এ সময় সহযোগিতা করেন নবীনগর থানা পুলিশ, নৌ পুলিশ ও আনসার বাহিনী। ২৩ আগস্ট বিকেলে রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি গড়াই নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করার অপরাধে দুই ড্রেজার চালকের ৭ দিন করে কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। বালু মহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইনে আদালত পরিচালনা করেন বালিয়াকান্দি উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) এহসানুল হক শিপন। আদালত পরিচালনায় সহযোগিতা করেন ভূমি কার্যালয়ের নাজির ও পুলিশ সদস্যরা। ২০ আগস্ট পটুয়াখালীর মহিপুর থানাধীন আন্ধার মানিক নদী মোহনায় খাজুরা বালুমহল থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের দায়ে ৫ জনকে ৫ লাখ টাকা জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন কলাপাড়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইয়াসীন সাদেক। এদিন অর্থদণ্ড অনাদায়ে তিন মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। ২১ আগস্ট পিরোজপুর জেলার ইন্দুরকানি উপজেলার কঁচা নদীতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের দায়ে ৭ জনের কাছ থেকে ৩ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এসময় বালু উত্তোলনে ব্যবহৃত ৩ টি ড্রেজার জব্দ করা হয়। ইন্দুরকানি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হাসান-বিন-মুহাম্মাদ আলীর নেতৃত্বে কঁচা ও বলেশ্বর নদীর মোহনায় এ ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। ইন্দুরকানি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হাসান-বিন মোহাম্মদ আলী জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ভ্রাম্যমাণ আদালত ঘটনাস্থলে পৌঁছে জড়িতদের হাতেনাতে ধরে ফেলে। এসময় তাদের ৩ লাখ জরিমানা এবং অনাদায়ে ৬ মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
অবৈধ বালু উত্তোলনে ঝুঁকিতে তিস্তা সেতু: ২৫ আগস্ট সাধারণ মানুষের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে তিস্তা সেতু। কিন্তু সেতুর পাশে নদী থেকে বালু তোলা হচ্ছে। খননযন্ত্র দিয়ে তোলা সেই বালু পাইপের মাধ্যমে ফেলা হচ্ছে তিস্তা সেতুর সংযোগ সড়ক ঘেঁষে একটি জমিতে। সেতুর মাত্র ৪-৫শ মিটার পূর্বে তোলা হচ্ছে এসব বালু। এতে ঝুঁকিতে গাইবান্ধা-কুড়িগ্রাম জেলার সীমান্তে নির্মিত স্বপ্নের হরিপুর তিস্তা সেতু। তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, হরিপুর ইউপি চেয়ারম্যান মাজহারুল ইসলামের সহায়তায় আইন লঙ্ঘন করে সেতুর কাছ থেকে বালু তুলে বিক্রি করছে প্রভাবশালী চক্র। তারা বালু উত্তোলনের মাধ্যমে তিস্তা সেতুকে ঝুঁকিতে ফেলছে। নদী থেকে বালু উত্তোলন বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি এলাকাবাসীর। এ বিষয়ে কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা আজগর আলী এর সঙ্গে। তিনি বলেন, বালু তোলার কারণে তিস্তা সেতুর সংযোগ রাস্তাসহ ফসলি জমি হুমকির মুখে। প্রশাসন জানার পরও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তবে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন হরিপুর ইউপি চেয়ারম্যান মাজহারুল ইসলাম।
অবৈধভাবে বালু উত্তোলন আইনে যা আছে: অবৈধভাবে বালু উত্তোলন রোধে সরকারের পক্ষ থেকে একটি আইন করা হয়েছে-বালুমহাল মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০। এই আইনের ধারা ৪-এর উপধারা (গ) মতে, বালু বা মাটি উত্তোলন বা বিপণনের উদ্দেশ্যে ড্রেজিংয়ের ফলে কোনো নদীর তীর ভাঙনের শিকার হতে পারে এরূপ এবং উপধারা (ঙ) অনুযায়ী, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন উক্ত বোর্ড কর্তৃক চিহ্নিত সেচ, পানি নিষ্কাশন, বন্যানিয়ন্ত্রণ বা নদীভাঙন রোধকল্পে নির্মিত অবকাঠামোসংলগ্ন এলাকা হলে বালু বা মাটি উত্তোলন নিষিদ্ধ। এছাড়া এ আইনের ধারা ৫(১)-এ বলা হয়েছে, পাম্প বা ড্রেজিং বা অন্য কোনো মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ বালু বা মাটি উত্তোলন করা যাবে না।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

* কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করার হুঁশিয়ারি স্থানীয় প্রশাসনের * যা আছে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন আইনে
দেশজুড়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের মহোৎসব
- আপলোড সময় : ০৪-০৯-২০২৫ ১২:৩৭:২৪ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৪-০৯-২০২৫ ১২:৩৭:২৪ পূর্বাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ